পৌষের কনকনে শীতের মধ্যেও খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও রস থেকে গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নাটোরের গুরুদাসপুরের গাছিরা। চলতি শীত মৌসুমে এ উপজেলায় ২২ কোটি টাকার খেজুরগুড় উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কৃষি অফিস।
গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর,চাপিলা,মশিন্দা,বিয়াঘাট,খুবজীপুর,ধারাবারিষা ইউনিয়ন ও পৌর সদরের সবখানেই কমবেশি খেজুরের রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করা হয়। এর মধ্যে নাজিরপুর ও বিয়াঘাট ইউনিয়নে খেজুর গাছের সংখ্যা বেশি থাকায় সেখানে গুড় উৎপাদনও বেশি হয়ে থাকে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, গুরুদাসপুরে রস দেওয়ার মতো উপযোগী গাছের সংখ্যা ৭৫ হাজার ৯৪০টি। শীতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ৭৫ দিন খেজুর রস সংগ্রহের জন্য ধরা হয়। এ সময়ে উপজেলাজুড়ে অন্তত ১ হাজার ৫০০ মানুষ খেজুরের রস সংগ্রহ, গাছের পরিচর্যা এবং গুড় তৈরিতে যুক্ত থাকেন। রস সংগ্রহের উপযোগী প্রতিটি গাছের রস থেকে গুড় উৎপাদন হয় ১৭ দশমিক ৪০ কেজি।
কৃষি অফিস বলছে, শীত মৌসুমে প্রায় ১ হাজার ৩২২ মেট্রিক টন খেজুর গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কেজির হিসেবে ১৩ লাখ ২১ হাজার ৩৫৬ কেজি খেজুরের গুড়ের বাজার মূল্য প্রায় ২২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা (প্রতি কেজি গুড়ের বর্তমান বাজার ১৮০ টাকা)।
স্থানীয়রা জানান, শীতের ভোরে গ্রামীণ জনপদের বিশেষ এক শ্রেনীর মানুষ খেজুরের রস সংগ্রহে বেড়িয়ে পড়েন। কুয়াশা ভেদ করে সূর্য্য উঁকি দেওয়ার আগেই গ্রামের গাছিদের বাড়িতে মটির চুলায় প্লেনশীটের তাওয়ায় সেই রস জ্বাল করে গুড় তৈরির কাজ শুরু হয়। খেজুর গাছ থেকে সংগৃহীত রস থেকে পাটালী এবং নলেন গুড় তৈরী হয়ে থাকে।
বিলচলন শহীদ সামসুজ্জোহা সরকারি কলেজের কৃষি শিক্ষা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জহুরুল ইসলাম বলেন, দেশের ভোজনরশিক মানুষের কাছে খেজুরের রস এবং গুড়ের খ্যাতি রয়েছে। চাহিদা পূরণে খেজুরের গাছ রোপনের সরকারি উদ্যোগ দেখা না গেলেও নির্বিচারে কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। সুস্বাদু খেজুরের গুড় গুরুত্বপূর্ণ মিষ্টান্নের চাহিদা পূরণ, হরেক প্রকারের পিঠার অন্যতম উপকরণ এই গুড়ের বাণিজ্যিকরণে তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না।
পরিবেশবাদী ও সংগঠক এ্যাডভোকেট শহিদুল ইসলাম সোহেল বলেন, বাণিজ্যিকভাবে খেজুরের গাছ রোপনের উদ্যোগ নেই। প্রাকৃতিকভাবে ঝোপ-ঝাড়ে অযত্নে অবহেলায় বেড়ে উঠা গাছগুলোই সুস্বাদু খেজুরের গুড়ের চাহিদা পূরণ করে। শুধু রস আর গুড়েই শেষ নয়। খেজুর গাছের পাতা এবং কাঠের রয়েছে নানাবিধ ব্যবহার।
গাছিরা জানান, শীত শুরু হলে উপযোগী খেজুর গাছের ডাল পালা প্রথমে পরিস্কার করা হয়। এরপর গাছের নির্দিষ্ট জায়গায় বেশ ক’দিন ছেঁটে ছেঁটে রস আসা শুরু হলে দৈনিক কেটে কেটে মাটির পাত্রের সাহায্যে রস সংগ্রহ করা হয়। ভোরে প্রতিটি গাছ থেকে সংগ্রহ করা রসগুলো বিশেষ কড়াইয়ে জ্বাল করা হয়। জ্বালানো রস অনেকটা আঠালো পর্যায়ে পৌছালে কড়াই থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করা হয়। সহনীয় গরম গুড় মাটির বিশেষ পাত্রের উপর পলিথিন বিছিয়ে সেখানে রাখা হয়। জমাট বাধা পর্যন্ত অপেক্ষা করে নামিয়ে নিলেই বিক্রি উপযোগী গুড় পাওয়া যায়। একজন গাছি দৈনিক সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০টি খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করতে পারেন। শীত মৌসুমে একটি খেজুর গাছ থেকে গড়ে ১৭ থেকে ২০ কেজি গুড় পাওয়া যায়।
গুরুদাসপুর পৌর শহরের আনন্দ নগর মহল্লার গাছি শফিকুল ইসলাম বলেন, এটা তাঁর পৈত্রিক পেশা। শীত মৌসুমে তিনি ২০টি খেজুর গাছ ইজারা নিয়েছেন। প্রতিটি গাছের বিপরীতে মালিককে ২ কেজি করে গুড় দিতে হচ্ছে। ২০টি গাছ থেকে দৈনিক ৮ কেজি পাটালীগুড় তৈরী হচ্ছে। প্রতি কেজি খাটি গুড় বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়।
গাছি শফিকুল জানান, গুড় বিক্রি করে তাঁর দৈনিক আয় ১ হাজার ৪৪০ টাকা। এর মধ্যে রস সংগ্রহের মাটির পাত্র, রস জ্বালানোর কড়াই,গাছ কাটার হাসুয়া,জ্বালানী ও অন্যান্য খরচ ২শ টাকা। দৈনিক নিট আয় ১ হাজার ২৪০ টাকা। শীত মৌসুমে লক্ষাধিক টাকা আয় হবে তার। তিনি আরো জানান, খেজুর গাছ নিধন,জ্বালানী সংকট,অমানবিক পরিশ্রম বলে অধিকাংশ গাছি পেশা বদল করেছেন। এমন চলতে থাকলে আগামীতে খেজুর রস আর গুড় পাওয়া দুস্কর হবে।
গাছি শাহাবুদ্দীন, রাহেন গাইনসহ আন্তত ১০ জন গাছি জানান, খেজুরগুড় উৎপাদন এবং বিপনন সংক্রান্ত কোনো সরকারি সহায়তা পান না। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চিনি,ক্ষতিকর রং, কেমিক্যাল মিশিয়ে খেজুরের গুড় তৈরি করে তা বাজারে বিক্রি করেন। তাছাড়া দীর্ঘদিনের পঁচা পাটালী এবং ঝোলাগুড় মিশিয়েও গুড় তৈরি করা হয়। এতে করে ভোক্তারা খাটি গুড়ের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ভেজাল গুড় কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। তারা ভেজাল গুড় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কে এম রাফিউল ইসলাম বলেন, কৃষি বিভাগ খেজুরগুড় উৎপাদন এবং বিপনণ বিষয়ে গাছিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। ভেজাল গুড় উৎপাদন এবং বিপননের বিষয়ে সার্বক্ষনিক নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিডি২৪অনলাইন/সি/এমকে