দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই এখন এক ভয়াবহ চক্র সক্রিয়— চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, চোর আর ডাকাত। বিশেষ করে শহরাঞ্চল থেকে গ্রাম পর্যন্ত এই অপরাধীরা সাধারণ মানুষের জীবনে চরম নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে। তারা যেমন রাতের আঁধারে হামলা চালায়, তেমনি দিনের আলোতেও ভয়ডরহীনভাবে অপকর্ম চালিয়ে যায়। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছে আতঙ্কিত ও অনিরাপদ।
অপরাধের এই বাড়বাড়ন্ত কেবল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতার দিকেই ইঙ্গিত করে না, এটি সমাজের নৈতিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং প্রশাসনিক দুর্বলতারও প্রতিচ্ছবি।
চাঁদাবাজির সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, এটা একটা অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনীতি গড়ে তোলে। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের থেকে শুরু করে যানবাহন চালকদের কাছ থেকেও নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে চাঁদা দিচ্ছেন, কারণ প্রতিরোধ করতে গেলে শারীরিক ক্ষতির শিকার হতে হয়। এই পরিস্থিতি একমাত্র কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপেই রোধ করা সম্ভব।
সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বাঁচে, আর ছিনতাইকারীরা রাতের আধারে নিরীহ পথচারী, যানবাহনের যাত্রীদের নিশানা বানায়। এগুলো কেবল সম্পদের ক্ষতিই করে না, অনেক সময় জীবনও কেড়ে নেয়। ফলে মানুষ আতঙ্কে সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলেও এখন ডাকাতি-চুরির ঘটনা বেড়েছে। কৃষকের ঘরের ধান থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোন পর্যন্ত চুরি হচ্ছে। অনেক সময় গ্রামের ভেতর সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের তাণ্ডবে সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে পড়ছে।
এমন পরিস্থিতিতে তাহলে করণীয় কী হতে পারে। ১. আইনের কঠোর প্রয়োগ: অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। থানা, তদন্ত, প্রসিকিউশন ও বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব, ঘুষ এবং অনৈতিক সহানুভূতি বন্ধ করতে হবে।
২. রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জিরো টলারেন্স নীতি: রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দলের ভেতরের অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে। কোনো ধরনের ছাড় না দিয়ে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
৩. কমিউনিটি পুলিশিং জোরদার করা: জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এলাকাভিত্তিক কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম বাড়াতে হবে।
৪. সিসিটিভি ও প্রযুক্তির ব্যবহার: শহর ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পর্যাপ্ত সিসিটিভি স্থাপন, অপরাধীদের ট্র্যাক করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
৫. সচেতনতা ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়া: পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা ও সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
৬. দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল: বিশেষ অপরাধের জন্য আলাদা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে বিচারপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও দ্রুত করতে হবে।
চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, ছিনতাই, ডাকাতি কিংবা চুরি—এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং আমাদের সামাজিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতার প্রতিফলন। এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হলে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, এবং আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ। নইলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো পরিবার হারাবে তার প্রিয়জন কিংবা জীবনের শান্তি।
লেখক: সাংবাদিক, বরগুনা।