প্রেসক্লাব এখন সিন্ডিকেটের দখলে, সভাপতি ও সম্পাদকের আয় কী?

কৃষ্ণ ভৌমিক
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

দিন যাচ্ছে আর কত কিছুই না পরিবর্তন হচ্ছে! প্রেসক্লাব নির্বাচনেও কয়েক বছর ধরে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। এখন  প্রেসক্লাবের নির্বাচনে পোস্টার ছাপিয়ে ভোটারের দোয়া আর ভোট চাওয়া হচ্ছে। কেবল প্রেসক্লাবের গন্ডির মধ্যেই নয়, গোটা শহরজুড়ে পোস্টারিং করার ঘটনাও ঘটছে। শুধু তাই নয়, প্রেসক্লাব নির্বাচনে  রাজনৈতিক শক্তি মাফিয়া চক্রের ব্যবহার দিনের পর দিন বাড়ছে।

ভোটের হার-জেতার রাত হচ্ছে  ভোটের আগের রাত। রাতকে গ্রামীণ প্রবাদে  ছয়কালে রাত বলা হয়। তেমনি প্রেসক্লাব নির্বাচনের আগের রাতে টাকা দিয়ে ভোট বিকিকিনি এখন নির্বাচনে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। এটা যেন সব জায়গাতেই বিজয়ী হওয়ার মুল কৌশল

ভোটের আগের রাতে টাকার পাশাপাশি ধর্মীয় অনুভুতিকে ব্যবহার করে প্রেসক্লাব নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে!   টাকার বিনিময়ে যে সাংবাদিকের ভোট কেনা হয়েছে, তার  হাতের সাথে আকস্মিকভাবে ছোট ধর্মগ্রন্থ  ছুইয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়- আপনি কিন্তু পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ছুয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে কি জঘন্য বিভৎস রুপ দেখতে হচ্ছে।

প্রেসক্লাব নির্বাচন নিয়ে লিখতে বসে  নিজেকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে পেশার পরিক্রমায় যে বিষয়টি মনে হচ্ছে, প্রেসক্লাব নির্বাচন এখন পুরাপুরি মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণে। এখানে সৎ নীতিবান সাংবাদিকদের কোন সুযোগ নেই। নীতিবানরা এখন সাইড লাইনে অবস্থান করছে। তারা নিজেরাও  নির্বাচনে প্রার্থী হতে নারাজ।

কেন নারাজ? তারা টাকা খরচ করতে পারবেন না। নির্বাচনেও জিততে পারবেন না। কারণ সৎ সাংবাদিকদের টাকার প্রাচুর্য যেমন নেই, আবার অনৈতিক পথ তারা বেছে নেবেন না। যোগ্যতা যতই থাক, তারা সময়ের বিবর্তনে যেন যোগ্যতাহীন। তারা এখন যোগ্যতাহীন পাগল ছাগল!

এখানে  প্রশ্ন জাগে প্রেসক্লাবে কি এতো মধু আছে যে, লাখ  লাখ টাকায় ভোট কিনে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হতে হবে? টাকা খরচ করে লাভ কি? প্রেসক্লাব সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের কি লোভনীয় বেতন-ভাতা আছে?

নির্বাচনের লাখ লাখ টাকার উৎস কি? টাকা কেন খরচ করা হয়? প্রেসক্লাবের  কাদের ভোট  টাকা দিয়ে কিনতে হয়? এসব প্রশ্নের উত্তরে বলা দরকার প্রেসক্লাব কি বা তার কাজ কি?

সাংবাদিকদের বিনোদনের জায়গা হচ্ছে প্রেসক্লাব। বিনোদনের পাশাপাশি নিউজের তথ্য আদান-প্রদানের জায়গা। প্রেসক্লাব সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান নয়।

প্রেসক্লাবের আয়ের উৎস হচ্ছে সংবাদ সম্মেলনে অডিটরিয়াম ভাড়া। আর যদি সম্পদ থাকে তার ভাড়া। সরকারি ও বেসরকারি অনুদান।

তাহলে নির্বাচন নিয়ে এত ডামাডোল কেন ? কেন লাখ লাখ টাকা দিয়ে ভোট কিনে জিততে হবে? সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে  পাশের  জেলায় প্রেসক্লাব নির্বাচনের  ঘটনা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম!

সেখানে সাংবাদিকদের ভোট বিপুল টাকা দিয়ে কেনা হয়! এখানেই শেষ নয়, তাদেরকে  ভোটের আগের দিন অন্য জেলার আবাসিক হোটেলে নিয়ে গোপনে আটকে রাখা হয়! ভোটের দিন তাদেরকে সাথে করে নিয়ে এসে ভোট দেয়ানো হয়। এর পর ছাড়া হয়। এসব করার  কারাণ তারা যেন অন্য প্যানেলে বেশি টাকায়  বিক্রি হতে না পারেন! এরা আবার প্রেসক্লাব সদস্যদের বিমান ভাড়া করে কক্সবাজার ভ্রমণ করিয়ে তাক লাগিয়ে দেন। বুঝুন, কত টাকার খেলা।

ঢাকার পাশে ২টি জেলায় প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি নির্বাচিত করা হয় কে কত টাকা খরচ করতে পারে তার ওপর। এখানে সর্বনিম্ন ৫০ লাখ থেকে ডাক শুরু হয়। যে বেশি টাকা ব্যয় করতে পারবে, তাদের প্যানেল নির্বাচিত করা হয়। এখানে টাকার পরিমাণ কিন্তু কম নয়। কয়েক কোটি টাকা না হলে তারা জিততে পারবে না।

এখন  প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের টাকা কে যোগান দেয়?  এলাকার শিল্প গ্রুপ তাদের প্রভাব প্রতিপ্রত্তি আর ব্যবসার স্বার্থে তাদের মনের মতো প্যানেলকে তারা সাপোর্ট দেয়। প্রেসক্লাব  হাতের মুঠোয় রাখতে তাদের ব্যবসায়ীক বিনিয়োগ বলা যায়।

এখানে ক্লাব সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের আয় কি? তারা নির্বাচনে বিপুল টাকা কেন খরচ করে? পদটা দখল করতে কেন এতো কামড়া-কামড়ি?  বস্তুত পদ অলাভজনক হলেও এখন পদের মুল্য অনেক। পদে বসতে পারলে টাকা নো ফ্যাক্টর। 

বালিমহল, মাটির ঘাট,বন্দর,বাসস্ট্যান্ট,অটোস্ট্যান্ড  মাসোহারা,ঠিকাদার সরকারি অসৎ কর্মকর্তার কাছ থেকে চাঁদা আদায়সহ কি থেকে আয় হয় না! অনেক জায়গায় রেজিষ্ট্রি অফিস থেকে মাসিক মোটা অঙ্কের চাঁদা  আদায়ের সঙ্গে বিজ্ঞাপন বাণিজ্য তো আছেই।  প্রেসক্লাবের উদ্যোগে জুয়া চালিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা কামাইয়ের ঘটনাও  ঘটছে। কসাইখানা থেকে জুয়া, গণিকার ঢেক আর সংবাদ সম্মেলনের নামে চুক্তি, সংবাদ ছাপানোর চুক্তি, ওয়ার্কসপ দোকান উদ্বোধন- সব জায়গাতেই তাদের রয়েছে লোভের হাতছানি।

বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে, সমাজে সাংবাদিক নাম শুনলে এক অপরের মুখের দিকে তাকায়। এর অর্থ হলো ব্যাটা বাটপার আসছে, না জানি কি ঝামেলায় পড়তে হয়! গ্রামগঞ্জে আজ সাংবাদিকদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখোমুখি।

এর জন্য দায়ী কে? কয়েকদিন আগে পাবনা সার্কিট হাউজে প্রেস কাউন্সিল আয়োজিত হলুদ সাংবাদিকতা প্রতিরোধ বস্তুনিষ্ট সাংবাদিকতা বিষয়ে এক প্রশিক্ষণে উপস্থিত ছিলাম প্রধান অতিথি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম। সেখানে অনেক ভালো ভালো কথা শুনলাম। সেখানেও প্রশ্ন উঠলো- কে দায়ী, প্রতিকারই বা কি?

আমার মনে হয়, অবাধে মিডিয়ার পারমিশন দেওয়ায় সংকট দিন দিন তীব্র হচ্ছে।টাকার বিনিময়ে মিডিয়া কার্ড  দিয়ে তাদের কামাই করার লাইসেন্স দিচ্ছে। তারা গ্রাম গঞ্জে জোর জুলুম করে টাকা আদায় করে নিজেরা যেমন চলছে, আবার মিডিয়াকে মাসোহারা দিচ্ছে।

একবার ভাবুন তো সাংবাদিকদের নির্বাচনেও টাকা দিয়ে ভোট কিনতে হয়? যারা ভোটার, তারা সাংবাদিক। আবার যারা ভোটে দাঁড়িয়েছেন, তারাও সাংবাদিক। যারা বিক্রি হচ্ছেন আর যারা কিনছেন, তাদের নৈতিক মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে?

কথা শুনলে তারা তেলে বেগুনে জ্বলবেন, এটা বলার অপেক্ষা নেই। তারা আরও বলবেন- পকেটে টাকা নেই, ব্যাটা বড় বড় কথা। হ্যাঁ আমিও তা মানছি- তোমাদের মতো পকেটে টাকা নেই, সম্পদ নেই তবে একটি বিষয় আছে, সেটা হলো মাথা উচু করে কথা বলতে পারছি। সেটা কিন্তু তোমাদের নেই

প্রেসক্লাব এখন সিন্ডিকেটের দখলে। এখানে কিছু সাংবাদিক সদস্য থাকেন। তারা বোমা মারলেও এক কলম লিখতে পারেন না। অন্যের কপি নিজ নামে চালিয়ে থাকেন। যারা এক সময় ক্লাব সদস্য হয়েছে, তারাও ভোটার। তাই রকম - ভোটই নির্বাচনের ফলাফলে ক্রিয়ানক হয়ে উঠেন।  যত টাকা লাগুক এদের কিনে ক্লাব দখল করতে পারলেই আর পায় কে? তখন টাকা আর টাকা! সারা দেশের অধিকাংশই একই চিত্র।

সাংবাদিকরা হচ্ছে  সমাজের দর্পন, সেখানে কি ছবি ভেসে উঠছে?  সমাজের যত অসঙ্গতি, ভুল-ত্রুটি  ধরিয়ে দিয়ে সমাজে সত্য সুন্দরের প্রতি মানুষকে যারা আকর্ষিত করবেন, তারাই যদি কুৎসিত কদার্য চরিত্রের হয়- তবে কি হবে? আমাদের সমাজে রক্ষক ভক্ষক হয়েছে   অথচ সাংবাদিকতা  মহান পেশা পেশাকে দেশ সেবামুলক পেশাও বলা যায়। তাই পেশায় আগে দরকার  নীতি-নৈতিকতা। এভাবে আর কতকাল? থেকে পরিত্রানের পথই বা কি তা বিচারের ভার পাঠকের উপরই ছেড়ে দিলাম।

লেখক: সংবাদকর্মী, দৈনিক জনকণ্ঠ,পাবনা।

 


মন্তব্য
জেলার খবর