একের পর এক মূলধন ঘাটতির ফাঁদে পড়ছে ব্যাংক। ঘাটতির অঙ্ক দিনকে দিন যাচ্ছে ভয়াবহ রূপে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মূলধন ঘাটতির মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত ও বেসরকারি মিলিয়ে ২৩ ব্যাংক। এদের সম্মিলিত ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ১১ হাজার ২৮৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় ঋণ বিতরণ এবং বিতরণ করা ঋণের বড় একটি অংশ ফেরত না পাওয়া ঘাটতির পেছনের কারণ। এ ঘাটতি কেবল আর্থিক দুর্বলতার চিত্র নয়, বরং দেশের ব্যাংকিং খাতের গভীর কাঠামোগত সঙ্কটের প্রতিচ্ছবি বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, দুর্বল পরিচালনা পর্ষদ, রাজনৈতিক প্রভাব এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
জানা গেছে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নতুন করে মূলধন ঘাটতির মধ্যে পড়েছে একাধিক ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে— ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক এবং আইএফআইসি ব্যাংক। সরকার পরিবর্তনের পর এসব ব্যাংকের ভেতরের আর্থিক দুর্বলতা ও ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের চিত্র স্পষ্টভাবে প্রকাশ হচ্ছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় আগে অনেক ব্যাংক অনিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণে জড়িত ছিল। এখন তার প্রভাবই মূলধন ঘাটতির রূপে সামনে আসছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মার্চ শেষে ২৩টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি দেখা গেছে কৃষি ব্যাংকের। ঘাটতির পরিমাণ এ ব্যাংকে ১৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। এর পরেই আছে ইউনিয়ন ব্যাংক, ঘাটতির পরিমাণ ১৭ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক জনতার ঘাটতি ১২ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৭ হাজার ৭৯০ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৬ হাজার ৯৩৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি ৬ হাজার ৪৫৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ৫ হাজার ৮২২ কোটি, পদ্মা ব্যাংকের ৫ হাজার ১৭০ কোটি ৭০ লাখ, রূপালী ব্যাংকের ৪ হাজার ৪৭০ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৩ হাজার ৯৮০ কোটি ৬১ লাখ, এবি ব্যাংকের ৩ হাজার ৬৯৩ কোটি এবং বেসিক ব্যাংকের ৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি। এছাড়া আইএফআইসি ব্যাংকের ২ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা, বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ২ হাজার ৫১০ কোটি ৬৯ লাখ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ৮১ লাখ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১ হাজার ৭৮২ কোটি, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৪৯৮ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১ হাজার ১৭১ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৯৫৪ কোটি, এক্সিম ব্যাংকের ৫২১ কোটি, সিটিজেনস ব্যাংকের ৮৬ কোটি সীমান্ত ব্যাংকের ২৬ কোটি এবং বিদেশি হাবিব ব্যাংকের ৩৬ লাখ টাকা মূলধন ঘাটতি রয়েছে।
এদিকে সংকট মোকাবিলায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলধন ঘাটতির তালিকায় থাকা ৫ ব্যাংককে খুব শিগগিরই একীভূত করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বাইরে প্রায় ১১টি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা মূল্যায়ন করা হচ্ছে, যেগুলোর অবস্থাও কমবেশি একইরকম বলে জানা গেছে।
ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মূলধন ঘাটতি পূরণের একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা চাওয়া হবে বলে জানা গেছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত ও কার্যকর না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে বাধ্যতামূলক প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যবেক্ষণ জোরদার করার পাশাপাশি মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিডি২৪অনলাইন/এনই/এমকে