করোনা মহামারির শুরুটা চীনের উহান শহরে হলেও তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো বিশ্ব। করোনা মহামারির তাণ্ডবে বিশ্বের অনেক দেশের জিডিপি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে শিল্প-কারখানা। কমেছে উৎপাদন। কর্মসংস্হান হারিয়ে অনেকেই এখন বেকার। এছাড়া রোজগার কমে যাওয়া, ব্যবসায় বাণিজ্যে স্থবিরতা, মুদ্রাস্ফীতি প্রভৃতি কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। সময় যাওয়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়েছে। করোনা রোগী সমাল দিতে গিয়ে নাকাল অবস্থা হাসপাতালগুলোর। ভেঙে পড়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ রাখতে একের পর এক বন্ধ করে দেয়া হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম শনাক্ত হয় করোনাভাইরাস। সংক্রমণের উর্ধ্ব গতি আঁচ করতে পেরে ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ করে দেয়া হয় দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সংক্রমণ ও মৃত্যর হার দু’টোই ক্রমশ বাড়তে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার অপেক্ষাও বাড়তে থাকে।
এক সময় যাদের পদচারণা ও কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠতো দেশের সকল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মাদরাসা। সেই শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে তা হয়ে পড়ে নিস্তব্ধ, প্রাণহীন। শ্রেণিকক্ষ, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিলে ধুলো-ময়লা জমে। হয়ে পড়ে অপরিচ্ছন্ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠ ঢেকে যায় ঘাস, লতাপাতা আর গুল্মে। মাঠগুলো হয়ে উঠে যেন গোচারণ ভূমি। বারান্দায় বেঁধে রাখা হতো গবাদিপশু। গত বোরো মৌসুমে ধান মাড়াই, খড় শুকানো এমনকী খড়ের গাদা দেয়ার স্থানেও পরিণত হয়েছিল কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠ। রক্ষণাবেক্ষণ অভাবে ক্ষতি হয়েছে অবকাঠামো। আজ পরিচিত ক্যাম্পাসটির দিকে তাকালে মনে হয়, ভুতুড়ে এক অচিন জায়গা!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও পড়াশোনায় চাপ না থাকায় পড়ার টেবিল ছেড়ে অনেক শিক্ষার্থীর দৃষ্টি নিবদ্ধ মোবাইলের স্ক্রিনে। আসক্ত হয়ে পড়েছে অনলাইন গেমসে। বিষণ্ণতায় ডুব দিয়ে আগামী প্রজন্ম।
প্রিয় সন্তানের এ হাল দেখে চরম উৎকন্ঠা আর হতাশায় অভিভাবকগণ। শুধু কী তাই! যে শিক্ষকরা নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে যাওয়া, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে অভ্যস্ত, গ্রীষ্মকালীন বা রমজানের মতো বন্ধেও যারা প্রতিষ্ঠান খোলার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন, প্রায় আঠার মাস বন্ধ থাকায় শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করতে না পারার মানসিক যন্ত্রণা তাদেরও কম ছিল না। অলস সময় কাটাতে কাটাতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন মানুষ গড়ার কারিগররা। আফছোস প্রকাশ করতেও দেখা গেছে অনেককে। গ্রামাঞ্চলের মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই হয়েছে বাল্যবিয়ের শিকার। করোনাকালীন সময়ে বাল্যবিয়ে যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষত মেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পারে শিক্ষার্থী সঙ্কটে। এমনই আশঙ্কা করছেন শিক্ষকবৃন্দ।
দীর্ঘ অপেক্ষার কালো অন্ধকার কেটে প্রভাতের সূর্য যেন উঁকি দিচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি জানিয়েছেন ১২ সেপ্টেম্বর থেকে খোলা হচ্ছে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এমন ঘোষণায় ঝাড়-পোচ শুরু হয়ে গেছে। ৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেরে ফেলতে হবে সব প্রস্তুতি। বিদ্যালয় খোলার সুখবরে শিক্ষার্থীরা বেশ উৎফুল্ল। অভিভাবকদের কাটতে শুরু করেছে হতাশা। আর শিক্ষকদের মাঝেও আনন্দ কম কিসে! কারণ শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের মধ্যেই তো মানুষগড়ার কারিগরদের পরম আনন্দ।
শুরুতে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির ক্লাস হবে সপ্তাহে একদিন। প্রতিদিন ক্লাস হবে পঞ্চম শ্রেণি ২০২১ ও ২০২২ সালে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের।
আপাতত বন্ধ থাকছে প্লে, নার্সারি, কেজি ও প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি। পরিস্থিতি বিবেচনা করে পর্যায়ক্রমে চালু হবে অন্যান্য সব ক্লাস। দীর্ঘ প্রায় ১৮ মাস পর আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আবারও হাসি আর আনন্দ নিয়ে তাদের প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এতে অভিভাবকদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও বেজায় খুশি। ১২ সেপ্টেম্বর কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পদচারণা-কোলাহলে আবারও মুখরিত হয়ে উঠবে ক্যাম্পাস। শ্রেণিকক্ষগুলো ফিরে পাবে প্রাণ। ফিরে আসবে ক্যাম্পাসগুলোর সেই চিরচেনা রূপ। সেই প্রত্যাশা আজ সবার।
এম এ মাসুদ
কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী