আনিসুর রহমান এরশাদ
চারদিকে ভাঙনের শব্দ! তিলে তিলে গড়ে তোলা সোনার সংসার মুহূর্তেই ভেঙে যাচ্ছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বিকাশে পবিত্র বন্ধনগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেমন যেন অনেকেই নিজের দুনিয়া গড়ে তুলতে চাচ্ছে। ঠুনকো কারণেও পরিবার হয়ে উঠছে রণক্ষেত্র, অনিরাপদ ও ভঙ্গুর । এখন একক পরিবারের জয়জয়কার! পরিবারের ভেতরই সদস্যরা নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করছে। পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছে।
পরিবারে অশান্তির পেছনে সাম্প্রতিক প্রবণতা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, জীবনযাত্রা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসন চর্চার বিষয়টি ভেঙ্গে পড়েছে। সমাজে একটা শূন্য অবস্থা তৈরি হওয়ায় শিশু কিশোররাও নেতিবাচক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ভিডিও চ্যাটের মধ্যে দিয়ে ভার্চুয়াল বিশ্বে বেশি সংযুক্ত হয়ে সরে যাচ্ছে নিজের পরিবার-পরিজন-প্রিয়জনদের কাছ থেকে! যা সমাজের জন্য অশনি সংকেত।
বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে ক্রমাগত। ৭০ এর দশক থেকে বিশ্বব্যাপী বিবাহবিচ্ছেদের হারে উর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫০ ভাগ বিয়েই ডিভোর্স বা সেপারেশনের মাধ্যমে শেষ হচ্ছে। ডিভোর্সের মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটার শতকরা হার- প্রথম বিবাহের ক্ষেত্রে ৪১, দ্বিতীয় বিবাহের ক্ষেত্রে ৬০, তৃতীয় বিবাহের ক্ষেত্রে ৭৩। বাংলাদেশেও বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে। পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে ক্রমশ৷ যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে মানুষ৷ ভালোলাগা-ভালোবাসাও যাচ্ছে কমে৷ ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চারা বাবার বাড়ি আর মায়ের বাড়ি করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, অসহায় হয়ে পড়ছে।
লিভটুগেদার করছে এদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী অবিবাহিত জুটিদের একসাথে বসবাস করার হার ১৯৬৮ সালে ছিল ০.১% আর ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৪%। যুক্তরাজ্যে বিবাহিতদের ৮৫% মানুষই বিবাহের আগেই শারীরিক সম্পর্কে জড়াচ্ছে। অনেকে বিয়ে করার আগে সঙ্গীকে জানার জন্যও লিভ টুগেদার করছে। সম্পর্ক ভাঙার প্রবণতা বাড়ছে। দূরত্ব বাড়ছে। সুন্দর সম্পর্কগুলোর ঘটছে চরম পরিণতি। বাড়ছে অশান্তি। ক্রমাগত দূরে সরে যাওয়ার অনুভূতি সেন্স অব সেপারেশন তৈরি করছে। একাকিত্ব বাড়ছে। পরকীয়া প্রেম বাড়ছে। সমাজে অবিশ্বস্ততার হার দিনে দিনে বাড়ছে।
বেশিরভাগ দেশগুলিতেই মানুষের বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর হার কমেছে। বিবাহ কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ছে। বেশিরভাগ দেশেই মানুষ জীবনে দেরীতে বিবাহ করছে। ইংল্যান্ড ও ওয়ালসে ৩০ বছর বয়সেই বিয়ে করেছে - ১৯৪০ সালে জন্ম নেয়াদের ৮৩%, ১৯৫০ সালে জন্ম নেয়াদের ৭৯%, ১৯৬০ সালে জন্ম নেয়াদের ৬৪%, ১৯৭০ সালে জন্ম নেয়াদের ৪১% আর ১৯৮০ সালে জন্ম নেয়াদের ২৫%। সুইডেনে নারীদের বিয়ের গড় বয়স ১৯৯০ সালে ছিল ২৮, ২০১৭ সালে ৩৪ বছর হয়েছে। ১৯৭১ সালে ব্রিটেনে ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীদের প্রায় ৮৫% বিবাহিত ছিলেন; ২০১১ সালে এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৮%। গত শতাব্দীতে ছেলেদের গড় বিয়ের বয়স ছিলো ২৩ বছর, মেয়েদের ২২ বছর। এই শতাব্দীতে ছেলেদের গড় বিয়ের বয়স ২৮ বছর, মেয়েদের ২৭ বছর।
ধনী দেশগুলোতে সন্তানপালনকারী স্ত্রী-বিচ্ছিন্ন স্বামী বা স্বামী-বিচ্ছিন্ন স্ত্রী তথা সিঙ্গেল প্যারেন্টিং একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সারা বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক দশকে সিঙ্গেল প্যারেন্টদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ২০০০ সাল পর্যন্ত কোনো দেশেই সমলিঙ্গে বিয়ের আইনী বৈধতা ছিল না। ২০ বছর পরে দেখা যায় ৩০টি দেশ সমলিঙ্গে বিয়েকে আইনী বৈধতা দিয়েছে। সন্তান জন্ম দেয়ার প্রবণতা কমছে। ১৯৫০ সালে একজন নারী তাঁর পুরো জীবনে গড়ে ৪.৭ টি সন্তান জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু ২০১৭ সালে সেটি ২.৪ এ নেমে এসেছে। আইনগত জটিলতা এড়াতে বাংলাদেশে গর্ভ ভাড়া দেয়া বা নেয়ার বিষয়টি গোপনে হচ্ছে ৷ টেস্ট টিউব বেবি'র বিষয়টি আইনগতভাবে এখানে বৈধ এবং প্রকাশ্য।
সূত্র: poribar.net