উন্নয়নের অদম্য শক্তি, ক্ষুধা ও দারিদ্রকে জয়, প্রতিবেশ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার শপথ নিয়ে Sydny Harbar এ আতশ বাজি পুড়িয়ে যে বছর শুরু হয়েছিল তা বছরের একেবারে শুরুতেই করোনার মত ক্ষুদ্র ভাইরাসের কারনে এমনভাবে পদদলিত হবে তা কেউ-ই মেনে নিতে পারেননি। চীনের উহানে যে ক্ষুদ্রাকৃতি করোনা ভাইরাস ধরা পরেছিল তা যে সারা পৃথিবীকে এতো অসহায় করে তুলবে তা অনেকে ভবিষৎবাণী করলেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বছরের শুরুতেই হঠাৎ ‘পজিটিভ’ শব্দটি মানুষের কাছে ভয়াবহ রকম ‘নেগেটিভ’ হয়ে যায় এই করোনার প্রভাবে। ফলে বিশ্বব্যাপী হু-হু করে বাড়তে থাকে গরীব মানুষের মিছিল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুরুতে এই ভাইরাসকে চীনের আবিষ্কার এবং তৈরি বলে অবজ্ঞা করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, এটা শুধু এশিয়া অঞ্চলে সীমিত থাকবে। আমেরিকার এতে কিছু যায় আসে না। সম্ভবত তিনি সময়ের দেয়াল লিখন পড়তে ভুল করেছিলেন। চায়না থেকে এই ভাইরাস প্রথমে এশিয়া এবং পরে ইউরোপে ভয়াল থাবা বসায়।
দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়াতে এই ভাইরাস খুব বড় কোনো প্রাণহানি করতে না পারলেও পুরো এশিয়াকে ‘লকডাউন’ অবস্থানে দাঁড় করায়। ফলে বিরান হয়ে যায় জনপদ। ঘরবন্দি হয় মানুষ। জীবিকা না জীবন- কোনটা আগে তা নিয়ে গোটা পৃথিবীর মানুষ নতুন করে যুক্তি দেখানো শুরু করলেন। চীন করোনাকে বৃত্তে বন্দি করতে পারলেও এশিয়ার অন্য মহাশক্তি ভারত সেটা করতে পারেনি। সম্ভবত সাবেক কম্যুনিস্টরা গণতন্ত্রীপন্থিদের চেয়ে সু-শৃঙ্গল ও সুনাগরিক। ভারত মৃত্যুর দিক দিয়ে পৃথিবীর ৩য় স্থানে আছে। সবার আগে চীন তার উহান শহর খুলে দেয়। ফলে ঘুরতে থাকে চীনের অর্থনীতির চাকা। প্রায় পুরো পৃথিবীর করোনা পণ্য চায়না থেকেই সরবরাহ করা হয়। চায়না থেকে এসব সেবা ও সরবরাহ নেয় আমেরিকাও।
শুরুর দিকে অনেক নিরাপদ থাকলেও সময়ের সাথে সাথে রাশিয়ায় বাড়তে থাকে করোনার তাণ্ডব লীলা। আর ফিকে হতে থাকে পুতিন জাদু। তবে কঠিন সঙ্গনিরোধ আইন প্রয়োগ করায় বছর শেষে নিয়ন্ত্রণে আসে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস। তবে সবাইকে টেক্কা দিয়ে পৃথিবীর প্রথম টিকা আবিষ্কারের গৌরব অর্জন করে রাশিয়া। অনেকে মনে করেন- করোনা বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও পুষিয়ে দেবে এই টিকা বাণিজ্য।
মধ্যপ্রাচ্যে এই করোনাভাইরাস এসেছে প্রথমে সৌদি আরবে, তারপর দুবাই এবং অন্য কিছু দেশে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি জীবন ক্ষয় হয়েছে ইরানে। ইরানে এমন খারাপ অবস্থা হওয়ার কারনটা সম্ভবত দীর্ঘ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবরোধ। আর এ অবরোধের কারনে চিকিৎসা বাবস্থার দৈন্য দশা। যুদ্ধ বিধ্বন্ত অন্য সব দেশেও করোনাভাইরাস হানা দিলেও যুদ্ধকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। ফলে আরব বসন্তে ব্যস্ত যোদ্ধাদের দমাতে পারেনি করোনা।
দরিদ্র পীড়িত আফ্রিকা মহাদেশে করোনাভাইরাস হানা দিলেও তেমন কোন বিশাল বা স্থায়ী ছাপ রাখেনি। দৈনন্দিন জীবনে সামান্য ছেদ পড়লেও চির যোদ্ধা আফ্রিকান ভূমিপুত্ররা এটাকে গায়ে মাখেননি। অন্য বছরের ন্যায় এ বছরও দারিদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছিলো তাদের। ক্ষুধার কাছে পরাজিত হয়েছিল করোনা।
আফ্রিকায় তেমন কিছু করতে না পারলেও করোনায় ব্যাপক ক্ষতি করেছে ল্যাটিন আমিরিকায়। মৃত্যুহারে কখনো ২ অথবা ৩ নম্বরে থেকেছে পুরো বছর। এমন কি পৃথিবীতে একমাত্র এই এলাকায় উপহার হিসেবে কফিন দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালগুলো মর মর করে টিকে আছে। রাস্তায় পড়েছিলো মানুষের লাশ। লাশের সৎকার করতে ইউরোপের অনেক দেশে সেনাবাহিনী ডাকতে হয়েছিলো।
চায়না থেকে প্রথম ইউরোপের ইটালিতে আক্রমণ করে করোনাভাইরাস। সারা ইউরোপ লকডাউন করলেও মুখোমুখি হয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ মানবিক সঙ্কট। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের টানাটানি ইউরোপকে নতুন এক শিক্ষা দিয়েছে। অনেক জনপদে কারফু দিতে হয়েছে। এই সঙ্কটে চিকিৎসকরা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ অন্যান্য জরুরি সেবার সদস্যরা তাদের পেশাগত দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। মানুষ আবার তাদেরকে নিয়ে গর্বিত হয়েছেন। ধর্ম, বর্ণ ও জাতি বলি দিয়ে দুনিয়ার নানা অজানা প্রান্তে রচিত হয়েছে মানবিকতার নতুন উদাহরণ।
করোনার প্রভাবে সব শহর একসাথে বন্ধ হওয়ায় পৃথিবীর বড় বড় স্টক মার্কেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পতন লক্ষ্য করে। মুহূর্তে বড় বড় ধনবানরা পথে এসে দাঁড়ান সাধারন মানুষের কাতারে, এ যেন Corona E qualizers চলছে।
ল্যাটিন অ্যামেরিকা ও ক্যারিবিও অঞ্চলে সরকারের উপর গণমানুষের অনাস্থা নতুন কিছু না হলেও এর সাথে ২০২০ সালে যোগ হয়েছে লকডাউন নামক যন্ত্রণা। গণকর্মহীনতায় চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট। সারা বছর ব্রাজিল, মেক্সিকো, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া আর বেশ ক’টি দেশে ছিলো আন্দোলন মিছিল-সভা এবং না পাওয়ার বেদনার বিস্ফোরণ।
সারা পৃথিবীতে মানুষ মানুষের কাছে থাকা ও না থাকার নানা ইতিহাস তৈরি করে চলেছে। করোনায় প্রমাণিত হয়েছে- কিছু কাজ বাদে প্রায় সব কাজ বাসায় থেকে করা যায়। করোনায় লকডাউন থাকায় সারা পৃথিবীর আবহাওয়ার দারুণভাবে ভাল হয়ে গেল। পরিবেশ একটা সুযোগ পেল। অনেক বিরল প্রজাতির প্রাণীরা বংশ বিস্তার করলো। ধোঁয়াশা এত কমে গেল যে দিল্লির মত শহরও আবার বাসযোগ্য হলো।
বাংলাদেশে করোনা আসে মার্চ মাসের এমন সময়, যখন বাংলাদেশ জাতির জনকের জন্ম শতবার্ষিকী পালনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। প্রথম প্রায় ২ মাস লকডাউন থাকার পর সীমিত আকারে এবং তারপর স্কুল বাদে সব খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রথম দিকে আমদের অর্থনীতি একটা ধাক্কা খেলেও অপরাজিত বাঙ্গালী সব সময়ের মত বঙ্গবন্ধুর কন্যার ডাকে যার যা কিছু আছে তা নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়ায়। রেমিটান্স এবং তৈরি পোশাকখাত আবার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করলো। সারা পৃথিবীকে চমকে দিয়ে বাংলাদেশ বহু সূচকে ভারতকে পিছনে ফেলে নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিশালী অর্থনীতি হিসাবে প্রমাণ করে। সারা পৃথিবীর এই নাজুক অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশ রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আয় করেছে।
এই বছরই মার্চ মাস থেকে আমেরিকাতে এই ভাইরাস ব্যাপক হারে সংক্রমন শুরু হলেও ট্রাম্প যে অবহেলা দেখিয়েছেন তার মূল্য দিলো প্রায় ৩ লাখ মার্কিন জনগন। তার এই নীতি খোদ আমিরিকাতে তো বটেই সারা পৃথিবীতেও সমালোচনার ঝড় তুলেছে।
আমেরিকা প্রায় সারা বছরই আলোচনায় ছিল ট্রাম্প এর বিতর্কিত অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি ও তার বক্তব্যর জন্য। বছর শেষে মার্কিন নির্বাচন থাকায় অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ছিল সরগরম। প্রায় সব মার্কিন নির্বাচনে কোন না কোন ইস্যুতে প্রভাবিত হয়, এবার ছিল করোনা ইস্যু। Make america great again নামের যে জাদুর কাঠির উপর ভর করে ক্ষমতায় এসেছিলেন, সে কাঠি যে তার ক্ষমতা হারিয়েছে তা মনে হয় মি. ট্রাম্প বুঝতে দেরি করে ফেলেছিলেন।
পরে মরার উপর খাড়ার ঘা হিসাবে দেখা দেয় করোনা আক্রমণ। চূড়ান্ত নির্বাচনের মাত্র দিন দশেক আগে করোনায় আক্রান্ত হন খোদ মি. ট্রাম্প। আর তাতেই কুপোকাত হন হার মানতে নারাজ নাছোড় বান্দা এই ট্রাম্প। গত ৪ বছরে মার্কিন জাতির ভিতরে জাতি, বর্ণ, ধর্মকে সচেতনভাবে অপব্যবহারের মাধ্যমে সৃষ্ট গভীর ক্ষত সারিয়ে তলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মার্কিন জনগণের কাছে জো বাইডেন যে আবেদন করেছিলেন তা যে তাদের মনপুত হয়েছিল তা নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে। হেরেও নানা অপকৌশলে ফলাফল পরিবর্তনের যে বৃথা আইনি লড়াইয়ের চেষ্টা করেছিলেন- মার্কিন আদালত ও জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে যে জিতুক মার্কিন নির্বাচন এবার পুরো দুনিয়ার সামনে তাদের সম্মান হারিয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
করোনার প্রভাবে সারা দুনিয়ার অর্থনীতি ১৯৩০ সালের পর বড় অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে। ইংল্যান্ড ছাড়া অন্য কোনো দেশ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও অবস্থা যে নাজুক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নানা কৌশলের কারনে কিছুটা ভাল অবস্থানে আছে চীন, রাশিয়া ও ভারত। পণ্যের বা কাঁচামালের উৎস কোথায় এবং তা কত গুরুত্বপূর্ণ এবার তা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়েছে। জীবন ও জীবিকা হারানো মানুষের মুখ নতুন নতুন রেকর্ড গড়েছে বিশ্ব মিডিয়ায়। মানুষ শিখেছে অনেক নতুন অভিযোজন।
বছর শেষে ‘বড়দিন’ এ মানুষ যে একত্রিত হয়ে একটু দোয়া চাইবে- বহু শহর আবার বন্ধ হওয়ার কারনে তাও সম্ভব হয়নি। তবে দুনিয়ার মানুষ আশা করে- করোনার টীকা আবিষ্কার হওয়ায় এই বিপদ প্রায় কেটে গেছে। মানুষ জাতি আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে এই দুনিয়ায়। এই বছরে এমন প্রত্যাশা আমাদেরও।